আজ ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চালু হচ্ছে শ্যামপুর চিনিকল


মোঃ ইনামুল হক, রংপুর প্রতিনিধি

চার বছর বন্ধ থাকার পর আবারও চালু হচ্ছে রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল। সরকারের এই সিদ্ধান্তে চিনিকলটির আশেপাশের এলাকার আখ চাষি, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের মাঝে খুশির জোয়ার বইছে। আখ চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি ও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে এমন আশায় সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন ওই এলাকার মানুষ।

লোকসানের কথা বলে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর রংপুরের শ্যামপুর, গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকল, পঞ্চগড় চিনিকল, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল এবং পাবনা চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই সময় চিনিকল এলাকাগুলোতে ব্যাপক আন্দোলন হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর চিনিকলগুলো চালু করতে আন্দোলনে নামে সংশ্লিষ্টরা। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি চিনিকলগুলো চালুর সিদ্ধান্ত নেয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীন বন্ধ থাকা ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াইয়ের কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। তবে প্রাথমিক ধাপে সরকার রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল এবং দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকলের আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু করা হবে।

পরের দুটি ধাপে গাইবান্ধার রংপুর চিনিকল, পাবনা চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল ও পঞ্চগড় চিনিকল চালু করা হবে বলে এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।

১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের আফরোজা বেগম পারুল স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চেয়ারম্যানের কাছে ওই চিঠি পাঠিয়েছেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, মাড়াই স্থগিতকৃত চিনিকলগুলো পুনরায় লাভজনকভাবে চালুর জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের সুপারিশের ভিত্তিতে পর্যাপ্ত আখ প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল, দ্বিতীয় পর্যায়ে পঞ্চগড় ও পাবনা চিনিকল এবং তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকলের মাড়াই কার্যক্রম চালুর লক্ষ্যে স্থগিতাদেশ পুনরায় প্রত্যাহার করা হলো।রংপুর চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষিসহ এলাকার লোকজন অভিযোগ করেন, ২০২০-২১ বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াইক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে দণ্ডায়মান আখ জমিতে রেখে একেবারে শেষ মূহুর্তে চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ আখচাষী ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন।

তারা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবারও চালু করা হবে এই চিনিকলগুলো। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম এই রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি গত চার বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকুরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে চলমান অন্য চিনিকলগুলোতে। কাজ হারানো শ্রমিকরা পেটের দায়ে ভ্যান-রিক্সা চালানোসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।

গত চার বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। এই দৃশ্য দেখলে মানুষের সরব উপস্থিতির অভাব নিশ্চিত হওয়া যায় খুব সহজে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো।

আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের এক সময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণ কাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর পর শেষ হয় মিলটির নির্মাণ কাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সকল চিনিকলকে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা ৮ একর, সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং ৮টি সাবজোন।

এছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এ সময়কালে ৫৬ লক্ষ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।

রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউজে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিলো নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহন করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য।

রংপুর চিনিকলকে ঘিরে জাঁকজমক ছিলো মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন। বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। শিক্ষার প্রসারেও অন্যতম ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষীসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর চিনিকল।

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান বলেন, রংপুর চিনিকলসহ মাড়াই স্থগিতকৃত ছয়টি চিনিকল পুনরায় চালুর বিষয়টি আমিও শুনেছি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এই চিনিকলটি চালু হলে অবশ্যই লাভজনক অবস্থায় উন্নীত হবে। কারণ এখানকার মাটি ও পরিবেশ আখচাষের জন্য খুবই উপযোগী।

রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান সুজা বলেন, দেশের কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে বিগত স্বৈরাচারী সরকার রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিশিল্প বন্ধ করে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত করেছিল। চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় এই জনপদের সকল স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। বর্তমান সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্ন করে পুনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা খুই বাস্তবসম্মত। আমরা একে স্বাগত জানাই।

মিলস গেট সাবজোনের আখচাষী ফেরদৌস আলম অভিযোগ করে বলেন, রংপুর চিনিকলের চাইতে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখ জোন এলাকায় আখও উৎপাদন হয় কয়েক গুণ কম। তারপরও ওই মিলটি চালু রেখে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহন করতে অতিরিক্ত ব্যয় করার মাধ্যমে এ শিল্পটি চিরতরে বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। বন্ধ চিনিকলগুলো পুনরায় চালুর বর্তমান সরকারের ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর